কৃষকের পরম বন্ধু গোলা নিয়ে কিছু কথা
চুয়াডাঙ্গা পতিনিধিঃ
বায়েজিদ জোয়ার্দার
চুয়াডাঙ্গা জেলার যিনি যতই বিখ্যাত-প্রখ্যাত হোন না কেন, গোলা চেনেন না এমন মানুষ বিরল। আর যারা গ্রামে জন্ম নিয়ে বড় হয়েছেন, তাদের প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে এই গোলা। তারা নিশ্চয় এর ব্যবহার কাজে-কর্মে করেছেন। গোলাকে কোন জেলায় কী নামে মানুষ চেনে, তা বিস্তর জানি না। তবে কোথাও কোথাও এটাকে মরাই বলা হয়। গোলা দেখতে গোল হলেও এর ইতিহাস হয়তো অনেক লম্বা। আর এর নির্মাণ শৈলী আমাকে মুগ্ধ করে। আমাদের এলাকায় যেসব কারিগর গোলা বানাতেন তাদের বেশির ভাগ মানুষই প্রয়াত হয়েছেন। তাদের প্রয়োজন যেমনি ফুরিয়ে গেছে, তেমনি গোলার ব্যবহারও শেষ। চুয়াডাঙ্গা জেলার কোনো কোনো বাড়িতে এখন গোলা টিকে থাকলেও তা হয়তো বড্ড অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে! এই গোলা এক সময় গ্রাম বাংলার প্রত্যেক গেরস্ত বাড়িতে এক বা একাধিক ছিল। বিশেষ করে অন্যান্য ফসল যাই হোক গোলায় রাখা হতো ধান। তবে বস্তা ভরে নয় ধাঁমায় ভরে ভরে গোলার ভেতর ফেলা হতো।
আমাদের গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার পদ্মবিলা ইউনিয়নের খেজুরা গ্রামে। আমাদের বাড়িতে বড় একটা গোলা ছিল। ১৬ থেকে ১৮ বিশ ধান ধরত ওই গোলায়। এই বিশের হিসাব নিয়ে একটু বলি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাঠে ঘাটে যাওয়া শুরু করি। সেসময় দেখেছি চাষি-গেরস্ত বাড়িতে মাপজোখের জন্য আধুনিক কোনো প্রযুক্তির ব্যবস্থা ছিল না। ভাত রান্নার সময় ব্যবহার হতো পালি। বেত দিয়ে দিয়ে বোনানো এক ধরনের ছোট পাত্র বিশেষ। তার চেয়ে একটু বড় পাত্রকে বলা হতো কাঠা। আরেকটু বড়টাকে বলা হতো ধাঁমা। ভাত রান্নার আগে হাঁড়ি চুলোয় বসানোর সময় চাল মাপা হতো পালিতে করে। এক পালিতে প্রায় কেজি দুয়েক চাল ধরত। দাদি এবং মাকে দেখেছি পালিতে মেপে চাল চুলোয় দিতেন। কোনো সময় এক পালি, কোনো সময় দেড় পালি, আবার কোনো কোনো সময় পৌনে এক পালি মেপে তারা ভাত রান্না করতেন। শ্রাবণ মাসের শেষ দিকে বা ভাদ্রের শুরুতে আমাদের গ্রামে ধান কাটা আর মলন মলার ধুম পড়ে যেত। মাঠের পর মাঠ আউশ ধান কাটতে চাষিরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ৮০ দশকের গোড়ার দিকে আমার কৈশোর বেলায় আমাদের বাড়িতে দুটো গোলা ছিল। একটা বড় আর একটা ছোট। বস্তা ভরে ধান আনার পর তা শুকিয়ে গোলায় ভরা হতো। তবে মেপে মেপে গোলায় তোলা হতো। একটা আন্দাজ করা হতো যে, এবার কয় বিঘা জমিতে কয় বিশ ধান হলো। সম্ভবত মাপটা এমন ছিল চার কাঠায় এক আড়ি, ১৬ আড়িতে এক বিশ। আর ১৬ বিশে এক পটে। আমার সেজ দাদি ইশারন নেছা বেঁচে আছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি এমনই হিসাব বললেন।
আমার মনে আছে, যেদিন ধান সিদ্ধ করার প্রয়োজন হতো তখন মা আমাকে গোলার ভেতর ঢুকিয়ে দিতেন। আমি ধামা ভরে ভরে গোলার ছোট্ট ধরজা দিয়ে বের করে দিতাম। আমাদের গ্রামে গোলা বানানো কারিগর তেমন ছিল না। ছেলেবেলায় দেখেছি পাশর্^বর্তী গ্রাম থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের গ্রামের কৃষকদের গোলা বানিয়ে দিতেন। একটা গোলা বানাতে বেশ কয়েকটা বাঁশ লাগত। প্রথমে বাঁশ কেটে গর্তের পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। আমাদের এলাকায় গর্তকে বলা হয় গেড়ে। গেড়ের পানিতে ১৫-২০ দিন বাঁশ পচানোর হতো। যাতে গোলা বানানোর পর তাতে ঘুণ না লাগে। এরপর গেড়ে থেকে বাঁশ তুলে দা ব্যবহার করে ফাড়া হতো। পরে গোলার কারিগররা নিপুণ হাতে বিভিন্ন রকম চটা তুলে ৭ থেকে ১০ দিন ধরে একটি গোলা বানাতেন। এ জন্য ব্যবহার করতেন তার ও একটি যন্ত্র। যে যন্ত্র দিয়ে তার এফোঁড় ওফোঁড় করা যেত। গোলাকার আকৃত্রির কারণেই হয়তো এর নাম গোলা হয়েছে। গোলার একটি মাত্র দরজা থাকত। তাতে কোনো রকম একটা মানুষ মাথা ঢুকিয়ে প্রবেশ করতে পারে; আবার একইভাবে বেরুতে পারে। গোলার কারিগরদের এক সময় কদর থাকলেও এখন কেউ তাদের খোঁজ করে না। গোলা বিলুপ্তির পথে। কোনো কোনো বাড়িতে গোলা টিকে থাকলেও তা অযন্ত অবহেলায় পড়ে আছে। তার ব্যবহার নেই। আর দু’বিশ বছর পর হয়তো গোলা বাস্তবে কেউ দেখতে পাবে না। আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি তাদের নাড়ি পোঁতা আছে গ্রামে। তাদের কাছে লেখাটা হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে। আমি এই জন্য এটা লিখছি যাতে বর্তমান প্রজন্ম গোলা সম্পর্কে জানতে পারে। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গোলার ছবিটা রেখে যাচ্ছি। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুগলে সার্চ দিয়ে হয়তো গোলার ছবি দেখতে পাবে এবং এ সম্পর্কে কিছু জানতেও পারবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এও ভাবতে পারে যে, আগের মানুষ এত বোকা ছিল, যে এর মধ্যে ধান রাখত! কিন্তু এটা বোকামির কিছু নয়। বংশ পরম্পরায় গ্রাম বাংলার মানুষ এভাবেই তাদের ভসলাদি রক্ষা করেছে। কারণ তখন মানুষের দালান বা পাকা বাড়ি তেমন ছিল না। কাঁচা ঘরে ধান রাখলে তা নষ্ট হয়ে যেত বা চারা বেরিয়ে যেত। আর গোলায় ধান রাখলে তা সারা বছর শুকনো থাকত। কোনো ক্ষতি হতো না। তবে সামান্য ইঁদুরের অত্যাচার ছিল বৈকি!
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সমৃদ্ধির প্রতীক গোলা। সেদিন আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি এখনও দুটো গোলা আছে। তবে ভাগাড়ে পড়ে থাকার মতো রয়েছে। কোন ফাঁকে কে কখন হয়তো ওই গোলা ভেঙে চুলোয় ঢুকিয়ে দেবে। গোলা দুটো দেখে আমার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার কাছে অসহায় গোলা দুটো যেন কেঁদে কেঁদে বলছে আমরা তোমাদের এত আপন ছিলাম, ছিলাম পরম বন্ধু। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে আমাদের এত দূরে সরিয়ে দিলে?